বুধবার, ১২ মার্চ ২০২৫, ০১:৫০ পূর্বাহ্ন
ওবায়দুল সমীর
——————-
ছোট্ট তুলি। সবেমাত্র ক্লাস ফোরে উঠেছে। মুখে তার সবসময় হাসি লেগেই থাকে। কোন কারনে রাগ করে বকা দিলেও হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে থাকে। মা বিরক্ত হলেও দাদুভাই বলেন- “আমার দাদুভাই কাঁদতে জানে না। ওর হাসিমুখ দিয়ে একদিন সবাইকে জয় করবে।”
মা মানতে নারাজ। বলেন- “এই হাসিই ওর বিপদ ডেকে আনবে। কোথায় হাসতে হবে, আর কোথায় কাঁদতে হবে দু’টোই জানা প্রয়োজন।”
দাদু বলেন- “ও নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না বৌমা, বয়সের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
এ জন্যেই দাদুকে ভীষণ পছন্দ করে তুলি। কোন কিছুতেই দাদুর বিরক্তি নেই। তুলির সব আগ্রহ আর ইচ্ছের মূল্য দেন দাদুভাই। তাই সারাদিন দাদুর সাথে ঘুরঘুর করে। দাদুর সাথে ফুলবাগানের যত্ন নেয়। বাড়ির পাশেই খালি যায়গায় দাদু গড়ে তুলেছেন ফুলের বাগান। কত রকমের ফুলগাছ লাগিয়েছেন দাদু। নানা রঙের ফুলে ছেয়ে গেছে পুরো বাগান। ফুলে ফুলে প্রজাপতির উড়োউড়ি আর পাখিদের কিচিরমিচির শুনতে কী যে ভালো লাগে তুলির।
ছোট্ট তুলি ছিলো দারুণ চঞ্চল আর কৌতূহলী। সে সবসময় নতুন কিছু জানার জন্য উদগ্রীব থাকে। দাদুর কাছ থেকে কত কত ফুলের নাম শিখেছে। কিভাবে গাছের যত্ন নিতে হয় ক’দিনেই সব শিখে নিয়েছে। সময় পেলেই বাগানে ছুটে যায়। আলতো হাতে ছুঁয়ে দেয় ফুলগুলো। ফুলেরাও তুলির আদর পেয়ে মাথা দুলিয়ে হাসতে থাকে। তুলির দেয়া খাবার পেয়ে পাখিরাও কিচিরমিচির করতে করতে পায়ের কাছে চলে আসে। তুলিকে ওরা মোটেও ভয় পায় না।
একদিন, তুলি বাগানে বসে একটি লাল গোলাপের দিকে তাকিয়ে ছিলো। এত উজ্জ্বল আর প্রাণবন্ত দেখাচ্ছিল গোলাপটিকে। কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারছিলো না তুলি। আলতো হাতে ছুঁয়ে দিতে গিয়েও হাত গুটিয়ে নেয়। যদি হাতের স্পর্শে ফুলটা ম্লান হয়ে যায়, নেতিয়ে পড়ে এই ভয়ে। মনে হচ্ছিল গোলাপটা তুলিকে কিছু বলতে চায়। তুলি মনে মনে বলে “ভালো থেকো গোলাপ”।
অন্য ফুলের দিকে তাকাতে যাবে হঠাৎ সে মৃদু একটি হাসির শব্দ শুনতে পেলো। আশেপাশে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেলো না। মনে হলো গোলাপ তাকে ডাকছে। ভালো করে তাকাতেই গোলাপের পাপড়ির মধ্যে ছোট্ট সোনালী একটা আলো ঝলমল করতে দেখে সে অবাক হয়ে গেলো।
“তুমি কে?” তুলি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো।
আলোটা ধীরে ধীরে বড় হলো। আর তুলি দেখল, এক ছোট্ট পরি গোলাপের ভেতর বসে আছে! তার নীলচে রঙের ছোট্ট ডানা, চকচকে সোনালি চুল আর রঙিন পোশাক দেখে তুলি মুগ্ধ হয়ে গেলো।
পরিটি মিষ্টি হেসে বললো, “আমি ফুলপরি! আমি বাগানের সব ফুলের যত্ন নিই। তুমি যে প্রতিদিন এখানে এসে হাসো, গল্প করো, তাতে ফুলগুলো খুব খুশি হয়।”
তুলি অবাক হয়ে বললো, “তাই নাকি!”
“তুমি কি জানো, তুমি খুব ভালো মেয়ে? তুমি যখন রঙিন ফুলের পাপড়িগুলো আলতো করে ছুঁয়ে দাও, তখন ওরা আনন্দে খিলখিল করে হেসে ওঠে। তুমি যখন ছোট্ট পাখিদের খাবার দাও, কিচিরমিচির করে ওরা তোমাকে গান শোনায়। তোমাকে দেখে গাছেরা আনন্দে নেচে ওঠে। তোমাকে দেখতে না পেলে আমারও কেমন যেন লাগে। তোমাকে দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়।”
“তাহলে কি আমি তোমার বন্ধু হতে পারি?” তুলি জানতে চায়।
ফুলপরি খিলখিল করে হেসে উঠলো। “অবশ্যই! তবে শর্ত আছে—তুমি সবসময় গাছপালা আর ফুলের যত্ন নেবে। পাখিদের কষ্ট দেবে না, আর প্রকৃতিকে ভালোবাসবে!”
তুলি খুশি মনে রাজি হলো। এরপর থেকে প্রতিদিন তুলি আর ফুলপরি একসাথে গল্প করত, ফুলেদের যত্ন নিতো, আর বাগানের সৌন্দর্য উপভোগ করত।
একদিন, তুলি দেখতে পেলো, ওর কিছু বন্ধু বাগানে ঢুকে গাছের ডাল ভাঙছে। সে দৌড়ে গিয়ে তাদের বললো, “দেখো, গাছেরা আমাদের বন্ধু। ওরা আমাদের অক্সিজেন দেয়, কার্বন-ডাই-অক্সাইড শুষে নিয়ে পরিবেশ নির্মল রাখে। ফুলফল দিয়ে আমাদের কতো সাহায্য করে! ওদের ডাল ভাংলে ওরা কষ্ট পায়। যদি আমরা তাদের কষ্ট দিই, তাহলে ফুলপরিও কষ্ট পাবে!”
ফুলপরির কথা শুনে তুলির বন্ধুরা প্রথমে হাসাহাসি করলো। তুলি যখন ফুলপরির কথা বললো, তারা কৌতূহলী হয়ে উঠলো। তুলির সাথে ফুলপরির বন্ধুত্ব আর কথোপকথন শুনে বন্ধুরাও খুশি হলো। পরের দিন বাগানে এসে সবাই দেখল, সত্যিই ফুলগুলো যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে হাসছে।
এরপর থেকে তুলি শুধু নিজে নয়, তার সব বন্ধুকেও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসতে শিখিয়ে দিলো। আর ফুলপরি? সে খুশিতে তুলি আর তার বন্ধুদের জন্য আরও সুন্দর সুন্দর ফুল ফোটাতে লাগলো!