শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০৩:২৬ অপরাহ্ন
মো:খলিলুর রহমান,সম্পাদক দৈনিক অপরাধ অনুসন্ধান:
বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বায়ান্নর ফেব্রুয়ারির ট্র্যাজিক ঘটনায় শহীদ হয়েছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর, আউয়াল, অহিউল্লাহসহ অনেকে। ১৯৫২ সালের ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ও মিলিটারির নির্মম গুলিবর্ষণ ও ট্রাকের চাপায় তাঁরা শহীদ হন। আহত হয়েছিলেন অগণিত নর-নারী। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বাংলা ভাষার যে মর্যাদা, তা আজও রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। শুধু কি তাই? ভাষা আন্দোলনে আত্মত্যাগকারী সব শহীদ ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদেরও আমরা যথাযথ মর্যাদা দিতে পারিনি। এমনকি নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত ও যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি সব শহীদের কবর। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসই কি নির্মোহভাবে লেখা হয়েছে? এ আন্দোলনের দলিলপত্রই কি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভবপর হয়েছে? এককথায় উত্তর, এসব হয়নি। এটা যে কতটা লজ্জা ও পরিতাপের, তা পর্যালোচনা করলেই ধারণা পাওয়া যাবে।
ভাষা আন্দোলনের মূলে ছিল পূর্ববঙ্গের মানুষের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক নানা শোষণ-বঞ্চনাজাত ক্ষোভ ও যন্ত্রণার বিস্ফোরণ। এ আন্দোলনের পথ ধরে ইতিহাসের নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করলেও; আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তিলাভ করতে পারিনি। সমাজে বৈষম্য ক্রমাগত বেড়েছে বৈ কমেনি। ফলে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগের সুমহান লক্ষ্য পূরণ তো হয়ইনি, বরং সাধারণ মানুষের জীবনে সমস্যা-সংকট আরও বেড়েছে। ফলে আকাশ ছোঁয়া ভোগ-বিলাসিতায় পূর্ণ অট্টালিকার পাশে ফুটপাতে দিনাতিপাত করা ছিন্নমূল মানুষের দেখা হরহামেশাই মেলে। সামাজিক নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এ ভূখণ্ডে আজও আসেনি।
এটা তো গেল আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক দিক। বাংলা ভাষার মর্যাদা কতটুকু প্রতিষ্ঠা হয়েছে কিংবা সর্বস্তরে এ ভাষার প্রচলনই-বা কতটা সম্ভব হয়েছে? পাঠ্যপুস্তক, অফিস-আদালত, বিচারালয়, গবেষণা—কোথায় বাংলা ভাষার যথাযথ ব্যবহার? উচ্চতর পঠন-পাঠনে তো বাংলা ভাষা আজ নির্বাসিত। দাপ্তরিক কাজেও একই অবস্থা। নামমাত্র আদেশ-নির্দেশ জারি হলেও এবং ফেব্রুয়ারি মাসে আবেগে গদগদ হয়ে বক্তৃতামঞ্চে গালভরা কিছু বুলি আওড়ানো কিংবা দু-একটি মামলার রায় বাংলায় প্রকাশ করা হলেও, প্রকৃতপক্ষে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রতিনিয়ত উপেক্ষিত হচ্ছে। পৃথিবীর অনেক দেশ মাতৃভাষায় পঠন-পাঠন ও জ্ঞানচর্চা দ্বারা উন্নতির শিখরে উঠলেও আমাদের ভাষিক ও মনস্তাত্ত্বিক দৈন্যের কারণে দিন দিন পেছনে পড়ে যাচ্ছি। এ থেকে উত্তরণে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ রাষ্ট্রের কর্ণধারদেরই গ্রহণ করতে হবে। কেবল সাংবিধানিকভাবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতিদানের মধ্যে আত্মতুষ্টি না খুঁজে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়ন করতে হবে। নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে হবে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও এর গৌরবগাথা। নতুন প্রজন্মকে শৈশব থেকেই মাতৃভাষা শিক্ষার ভিতটাও করতে হবে মজবুত।
আমাদের দেশে কাগজ-কলমে কিছু কার্যক্রম প্রচলিত থাকলেও বাস্তব চিত্র খুব করুণ। স্কুল-কলেজ তো দূরের কথা, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সিংহভাগ শিক্ষার্থী ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে কোনো ধারণা রাখে না। তারা জানে না নারীদের ভাষা আন্দোলনে অবদানের কথা। কেনই-বা রাষ্ট্রভাষা মর্যাদার দাবিতে আন্দোলন হয়েছিল এবং রাজপথে রক্ত ঝরেছিল, সে ইতিহাসও। কারাইবা লেখনীর মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের পটভূমি তৈরি করে দিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে তারা জানে না বললেই চলে। শহীদ মিনার নির্মাণের ইতিহাস তারা জানে না, এমনকি ভাষা আন্দোলনের শহীদদের নাম পর্যন্ত বলতে গলদঘর্ম হয়! এমনটি তো হওয়ার কথা ছিল না। শহীদেরা আত্মত্যাগ ও জীবন উৎসর্গ তো এ জন্য করেননি। বাস্তবে দায়টা কিন্তু নিজেদের তথা পূর্ববর্তী প্রজন্মের ওপরই বর্তায়। বিশেষ করে, আমরা যাঁরা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান করি, তাঁদের গাফিলতি ও ইতিহাসবিমুখতাই এর জন্য সর্বাংশে দায়ী। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরাও দায়মুক্ত নন। পরিবারগুলোর দায়বদ্ধতাও একেবারে উপেক্ষণীয় নয়। আমাদের সবাইকে দায়িত্ব নিয়ে নতুন প্রজন্মের সামনে ইতিহাসের গৌরবময় এসব ঘটনা তুলে ধরতে হবে। উচ্চশিক্ষায় বাংলা ভাষা প্রচলনে এবং তথ্যপ্রযুক্তির কাজ ও গবেষণায় এ ভাষাকে ব্যবহার-উপযোগী করতে হবে। বাংলা ভাষায় পাঠ্যপুস্তক ও সহায়ক গ্রন্থ প্রণয়ন করতে হবে। বাংলা ভাষাকে যুগের উপযোগী করতে হবে। কেবল কথায় নয়, কাজে প্রমাণ রাখতে হবে এবং দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।
পাঠ্যপুস্তকে ভাষা আন্দোলনের সব শহীদের (যাঁদের পরিচয় জানা সম্ভব হয়েছে) পরিচয় যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি প্রচারমাধ্যমে তাঁদের জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরতে হবে। সাধারণভাবে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর—ভাষা আন্দোলনের এসব শহীদ সম্পর্কে যৎকিঞ্চিৎ ধারণা অনেকের থাকলেও, রিকশাচালক আবদুল আউয়াল এবং কিশোর অহিউল্লাহ সম্পর্কে অধিকাংশের কোনো ধারণা নেই। ধারণা নেই ভাষা আন্দোলনের শহীদদের পরিবার সম্পর্কেও। অথচ ওই সময়কার সরকারি নথিপত্র, পত্র-পত্রিকা এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসগ্রন্থ ও দলিলপত্রে তাঁদের সম্পর্কে স্পষ্ট বিবরণ রয়েছে।
আমাদের সবচেয়ে দৈন্য ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে। যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠনের কর্মী হিসেবে খুব কাছে থেকে এই আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ অবলোকন করেছেন, তাঁরা সবাই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকের নির্মোহ দৃষ্টির প্রকাশ ঘটাতে পারেননি। ফলে কারও গ্রন্থে কমিউনিস্ট পার্টি ও এর ছাত্র-যুব-সাংস্কৃতিক সংগঠন; কারও লেখায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতা-কর্মী; কারও স্মৃতিচারণে তমদ্দুন মজলিস, ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ প্রভৃতি সংগঠনের অবদান উজ্জ্বলরূপে ধরা পড়েছে। এসব দৃষ্টান্ত আবুল কাশেম, আবদুল মতিন, বদরুদ্দীন উমর, বশীর আল্হেলাল, আহমদ রফিক, গাজীউল হক, এম আর আখতার মুকুল, মুহাম্মদ হাবীবুর রহমান, আনিসুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম, এম এ বার্নিক, মোহাম্মদ হাননান প্রায় সবার লেখা বই-পুস্তক নিবিড়ভাবে পাঠ করলে সহজেই অনুধাবন করা যায়। সময় সময় নিজ রাজনৈতিক আদর্শ ও সংগঠনের নেতা-কর্মীদের অবদানকে বড় করে দেখাতে গিয়ে অন্য সংগঠন ও আদর্শের নেতা-কর্মীদের অবদানকে উপেক্ষা করার প্রবণতাও এঁদের মধ্যে পরিদৃষ্ট হয়। এর ফলে ইতিহাসের সাধারণ পাঠক তো বটেই, অনুসন্ধানী গবেষকদেরও বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়। এসব দূরীকরণে প্রয়োজন ভাষা আন্দোলনের নির্মোহ ও সামগ্রিক দৃষ্টিতে ইতিহাস রচনার। এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে ইতিহাস-গবেষকদের।
সে ক্ষেত্রে যে কাজটি করতে হবে তা হলো, ইতিহাসে যার যা ভূমিকা, তা যথাযথভাবে তুলে ধরতে হবে। ভাষা আন্দোলনে অবদান রাখা প্রধান তিনটি রাজনৈতিক ধারা; যেমন ১. কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ফেডারেশন, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ; ২. পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ; ৩. তমদ্দুন মজলিস, ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ প্রভৃতি সম্পর্কিত তথ্য-উপাত্ত অনুসন্ধান করে তাদের অবদান চুলচেরা বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করে প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে হবে।
ফাইল ফটো
ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমরা আবেগ-ভারাক্রান্ত হই। লেখায়-কথায় শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সম্পর্কে পত্র-পত্রিকার পাতা ও সভা-সেমিনারের পরিবেশ জমজমাট করে তুলি। ফেব্রুয়ারি গেলেই সব ভুলে বসে থাকি। জাতি তথা নতুন প্রজন্মের সামনে এমন আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড বন্ধ রেখে বাস্তবসম্মত কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে, যার কিছু দিক এ লেখায় তুলে ধরা হয়েছে। সব নাগরিকের বাস উপযোগী শোষণ ও বৈষম্যমুক্ত স্থিতিশীল রাষ্ট্র গড়তে হবে। সার্বিকভাবে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগের মাহাত্ম্যে উজ্জীবিত হয়ে রাষ্ট্র ও এর নাগরিকদের যথাযথ ও কার্যকরভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। তবেই জাতি হিসেবে আমাদের দায়মুক্তি হতে পারে।