বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১২:২৩ অপরাহ্ন
এইচ.এম সিরাজ, সাম্য-প্রেম-মানবতা-অসাম্প্রদায়িতা-স্বাধীনতা ও “মানুষ” এর শ্রেষ্ঠতম কবি কাজী নজরুল ইসলামের চেতনা ও ভাবমর্যাদা অসঙ্গত নানা কারণে বিকশিত, সুরক্ষিত হয়নি বহুলাংশে। অথচ তা চেয়েছিলেন বলেই বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন স্বদেশে ফিরে এসে মাত্র সাড়ে চার মাসের মধ্যে ১৯৭২ সালের ২৪ মে এই মহান কবিকে ‘ওপার বাংলা’ থেকে এ দেশে নিয়ে আসেন এবং সে সুবাদে কবির একমাত্র ব্যক্তিগত অভিলাষ‘‘মসজিদের পাশে আমার কবর দিও ভাই’ যথাযথই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে । আর, ‘ওপার বাংলার’ বর্ধমান জেলার চুড়ু–লিয়া গ্রামের কাজী ফকির আহমদের পুত্র বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ‘বাংলাদেশের জাতীয় কবি’ অভিধায় আমরা পেয়েছি।
সম্ভবতঃ সমকালীন বিশ্বের একমাত্র অসাম্প্রদায়িক চেতানাধারী “সম্পূর্ণ মানুষ” কবি নজরুল ইসলাম বিশেষ করে তাঁর কাব্য-সাহিত্যের ছত্রে-ছত্রে দার্শনিকতার পরিস্ফুটন ঘটিয়েছেন বিস্ময়করভাবে এবং সে সবের মাহত্ম দিনে দিনে প্রকাশিত হচ্ছে স্পষ্টরূপে। আজকে তাই মোবাইল ফোন দেখিয়ে অনেকেই নজরুলের ‘সংকল্প’ কবিতার উদ্ধৃতি দেন:‘ বিশ্বজগৎ দেখবো এবার আপন হাতরে মুঠোয় পুরে।’ আবার কেউবা ‘জীবন বন্দনা’ কবিতা থেকে বলেন: নবীণ জগৎ সন্ধানে যারা ছুটে মেরু-অভিযানে/পক্ষ বাধিয়া উড়িয়া চলেছে যাহারা উর্ধ্বপানে/ তবুও থামে না যৌবন-বেগ জীবনের উল্লাসে;/ চলছে চন্দ্রে, মঙ্গলগ্রহে, স্বর্গে-অসীমাকাশে। কী বিস্ময়কর! কীভাবে দেখলেন নজরুল এসব? এখানে প্রশ্ন জাগে, ‘বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই নবী‘এ কথা নজরুল‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায় বলেন আমাদের সতর্কতার জন্য? এ ব্যাপারে গবেষণা হলে আমরা অনেক কিছু জানতে, বুঝতে পারবো।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশাল-চিত্তগুনে কবি নজরুলকে চিনেছিলেন বলেই আপন উদ্যোগে তাঁকে তাঁর কাংখিত স্বাধীন বাংলাদেশে এনে যথাযথ মর্যাদায় সমাসীন করেন। ফলে ইতিহাস-নির্ণিত পথে নজরুল আমাদের ‘জাতীয় কবি’ স্বীকৃতি পান; যদিও এ বিষয়ে আজো জাতীয় সংসদে আইন (জাতীয় কবি বিল) পাশ হয়নি। এখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ করতেই হয়, এর বহু পূর্বে আরো কিছু বাঙালী মহান মানুষের বিচক্ষণ উদ্যোগে ত্রিশ বছরের যুবক নজরুলকে ‘বাঙালী জাতির জাতীয় কবি’ অভিধায় কোলকাতায় এ্যালবার্ট হলে সাড়ম্বর সংবর্ধণা দেয়া হয় ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর। সেখানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় বৃটিশবিরোধী মহান পুরুষ নেতাজী সুভাষ বসু বলেন : ‘আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাবো¬Ñতখনো সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে। আমরা যখন কারাগারে যাবোÑ সেখানেও তাঁর গান গাইবো।… নজরুল যে স্বপ্ন দেখেছেন , সেটা শুধু তাঁর নিজের নয়, সমগ্র বাঙালী জাতির।’’ বিজ্ঞানাচার্য্য স্যার প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সভাপতিত্বে ওই অনুষ্ঠানে নেতাজী আরেকটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেন, ‘রাজনীতিবিদ হিসাবে আমি ভারতের সর্বত্র ঘুরে বেড়াই এবং সেই সুবাদে বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় রচিত জাতীয় সঙ্গীত শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তবে নজরুলের ‘‘কান্ডারি হুশিয়ার’’ গানটির মতো মন-মাতানো সঙ্গীত আর কোথাও শুনি নাই।’
১৯৭২ সালের ২৫ মে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত নজরুল-জন্মজয়ন্তী উপলক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান যে বাণী দেন, ইতিহাসের বিচারে তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। প্রদত্ত বাণীতে বঙ্গবন্ধু বলেন : কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাঙলার বিদ্রোহী আত্মা ও বাঙালীর স্বাধীন ঐতিহাসিক স্বত্তার রূপকার। বাঙলার শেষ রাতের ঘনান্ধকারে নিশীথ-নিশ্চিন্ত নিদ্রায় বিপ্লবের রক্তলীলার মধ্যে বাঙলার তরুণরা শুনেছে রুদ্র-বিধাতার অট্টহাসি, কাল ভৈরবের ভয়াল গর্জনÑনজরুলের জীবনে, কাব্যে, সঙ্গীতে ও তাঁর কন্ঠে। প্রচন্ড সামুদ্রিক জলোচ্ছাসের মতো, লেলিহান অগ্নিশিখার মতো, পরাধীন জাতির তিমির ঘন-অন্ধকারে বিশ্ববিধাতা নজরুলকে এক স্বতন্ত্র ছাঁচে গড়ে পাঠিয়েছিলেন এই ধরার ধূলায়।
আরেক মহৎপ্রাণ বাঙালী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুল নামের দুরন্ত ছেলেটাকে চিনেছিলেন গভীর ধেয়ানে ও কায়মনে। তেইশ বছরের যুবক নজরুল ‘‘ধূমকেতু” নামে অর্ধ-সাপ্তাহিক প্রত্রিকা বের করার উদ্যোগ নিয়ে তাঁর কাছে ‘আশীর্ব্বাণী’ আনতে গেলে ‘ধূমকেতু’ নামকরণের হেতুবাদ জানতে চান ‘গুরুদেব’। নজরুল তখন লাফিয়ে উঠে আবৃতি করেন:‘ আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃমাহাবিপ্লব হেতু;/ এই স্রষ্ঠার শনি-মহাকাল ধূমকেতু।…’ গুরুদেবের আর বুঝতে বাকী থাকে না ; তিনি আশীর্ব্ববাণী দেন:‘আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু,/ আঁধারে বাধ অগ্নিসেতু./ দুর্দ্দিনের এই দূর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন/ অলক্ষণের তিলকরেখা, রাতের ভালে হোকনা লেখা;/জাগিয়ে দে রে চমক মেরে, আছে যারা অর্দ্ধচেতন।’ বোধ করি এই-ই প্রথম কবি রবীন্দ্রনাথের কন্ঠে বিদ্রোহের বাণী শোনা গেলো; এবং তা যেনো অবিকল নজরুল-কন্ঠের প্রতিধ্বনি। এখানে আমার মনে হয়েছে, নজরুলের ধূমকেতু-রুপের মাহত্ম তাৎক্ষণিক হৃদয়য়াঙ্গম করতে পেরেই উপরোক্ত আশীর্ব্বাণী দেন বিশ্বকবি রবি ঠাকুর। আন্দাজ করা যায়, সেদিন সেই ক্ষণে-গুরুদেব বরীন্দ্রনাথ অলক্ষ্যে ও আকস্মাৎ ‘নজরুল’ হয়ে উঠেছিলেন। বিষয়টি স্পষ্ট করতে ‘ধূমকেতু’ কবিতার কয়েকটি চরণ এখানে উদ্ধৃত করছি:
‘আমি সর্বনাশের ঝান্ডা উড়ায়ে বোঁ বোঁ ঘুরি শূন্যে / আমি বিষধূম-বাণ হানি একা ঘিরে ভগবান অভিমুণ্যে। / এই শিখায় আমর নিযুত ত্রিশুল, বাসুলি বজ্রছড়ি / ওরে, ছড়ানো রয়েছে, কত যায় গড়াগতি; / মহা-সিংহাসনে সে কাঁপিছে বিশ্বসম্রাট নিরবধি / তাঁর ললাটে তপ্ত অভিশাপ-ছাপ এঁকে দিই আমি যদি! / তাই, টিটকিরি দিয়ে হাঁ হাঁ হেসে উঠি / সে হাঁসি গুমরে লুটিয়ে পড়ে রে তুফান-ঝঞ্ঝা-সইক্লোন টুটি।’ এমনি আরো বহু দুঃসাহসিক বাণীর গাঁথুনি দিয়ে রাচিত ‘ধূমকেতু’ কবিতা ‘বিদ্রোহী’র চেয়েও বেশি-বিদ্রোহী বলে আমার মনে হয়েছে। অতএব, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনায়াশেই বুঝেছিলেন সে মাহত্ম এবং নজরুলকে “বিজয়ী” ঘোষণা করেছিলেন, ‘উড়িয়ে দে তোর বিজয়-কেতন’ বলে।
বাঙালি জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কবি নজরুলের বিদ্রোহী-চেতনার রাজনৈতিক-প্রতিভূ। তাই তিনি অকপটে জনসভায় দাঁড়িয়ে বলতে পারেন, ‘আমার চারপাশে চোর ও চাটার দল; মানুষ সোনার খনি পায়, আমি পেয়েছি চোরের খনি; ওরা আমার কম্বলটিও চুরি করতে ছাড়েনি। বিশ্বের মানুষ আজকে দুইভাগে বিভক্তÑ শোষক এবং শোষিত, আমি শোষিতের পক্ষে।’ এছাড়াও আরো বড় উদাহরণ হচ্ছে-‘ রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব; তবু এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। শেখ মুজিবের এ ঐতিহাসিক ভাষণের মূল রূপকার কবি নজরুল।‘‘ কান্ডিারি হুশিয়ার’’ শীর্ষক কবিতায় নজরুল বাঙালীর স্বাধীনতার রূপকল্প তুলে ধরেন পরিস্কারভাবে:
‘কান্ডারি! তব সম্মখে ঐ পলাশির প্রান্তর / বাঙালীর খুনে লাল হলো যেখা ক্লাইভের খঞ্জর / ঐ গঙ্গারয় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর / উঁদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পুনর্বার।’ আর সে মতই আমরা সবুজ জমিনে লাল সূর্য খচিত স্বাধীন জাতীয় পতাকা অর্জন করেছি এক সাগর রক্ষের বিনিময়ে। সুতরাং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বয়সকাল ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত; অর্থাৎ ২১৪ বছর। তবে, একাত্তরের ‘৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ’ তার-ই মৌলিক অধ্যায়।
লেখক: নজরুল-ভাবুক কবি ও সাংবাদিক এবং
নজরুল চর্চা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান অগ্নিবীণা’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, মোবাইল : ০১৯১৩৪০৪২৯৭, ই-মেইল : hmsiraj.jst@gmail.com