মহিদুল ইসলাম (শাহীন) খুলনা থেকে,
অনেক বছর ধরে সনাতন পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষে খুলনা অঞ্চলে কম ছিল। জলবায়ু পরিবর্তন ও রোগাক্রান্ত পোনাসহ নানা কারণে উৎপাদনের আগেই চিংড়ি মারা যাওয়ায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তেন চাষিরা। এই অবস্থায় চাষিদের আশার আলো হয়ে সাসটেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিশারিজ প্রকল্পের ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ।
খুলনার ৫ জেলায় ৩০০টি স্থানে প্রথম বারের মতো এ পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ হচ্ছে। এতে উৎপাদন তিনগুণ বৃদ্ধির আশা মৎস্য দপ্তরের। আগামীতে এ পদ্ধতিতে চাষ আরও বৃদ্ধির দাবি সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের। জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি রোগমুক্ত পোনা না পাওয়া, ঘেরের গভীরতা কম থাকাসহ বিভিন্ন কারণে গত ৪/৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে খুলনা অঞ্চলে চিংড়ি উৎপাদন ক্রমান্বয়ে কমছিলো। ফলে একদিকে যেমন আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছিল চাষিরা, তেমনি দেশের চিংড়ি রফতানি বাজারও সংকুচিত হয়ে আসছিল।
এই পরিস্থিতিতে চিংড়ির উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রথম বারের মতো খুলনা অঞ্চলে ক্লাস্টার পদ্ধতিতে গলদা ও বাগদা চিংড়ি চাষের উদ্যোগ নেয় মৎস্য দপ্তর। সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিসারিজ প্রকল্পের আওতায় এক স্থানে ২৫ টি চিংড়ি ঘেরের পাশা পাশি রেখে চাষ করা হচ্ছে। বাগেরহাট,খুলনা, সাতক্ষীরা, যশোর এবং গোপালগঞ্জের ২৮/২৯ টি উপজেলায় ৩০০টি ক্লাস্টার গঠন করা হয়েছে। সনাতন পদ্ধতিতে হেক্টর প্রতি যেখানে চিংড়ি উৎপাদন হয় ৩/৪ শ কেজি, সেখানে এই পদ্ধতিতে চিংড়ি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা হেক্টর প্রতি এক হাজার কেজি। এপ্রিলে পোনা ছাড়ার পর এরই মধ্যে ঘেরগুলোতে চিংড়ি পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে। তাতে সুখের হাসি চাষির মুখে। তবে পুকুর খননে সরকারি সহায়তারও দাবি জানান।
দাকোপ উপজেলার নিরঞ্জন মন্ডল। গত কয়েক বছর ধরে ঘের করে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, ঘেরের পিছনে যে টাকা ব্যয় করতাম, লাভ তো দূরে থাক, আসল টাকাই উঠতো না। মাছ পুষ্ট হয়ে ওঠার আগেই অর্ধেকের বেশি মাছ মারা যেত। তবে এ বছর মৎস্য অধিদফতর থেকে আমাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এখন একসঙ্গে ২৫টি ঘের আমরা পাশাপাশি রেখে চাষ করছি। এসব ঘেরের গভীরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে, মান সম্মত পোনা ছাড়া হয়েছে। এপ্রিলে পোনা ছাড়ার পর এখন অনেকটাই পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে। আশা করছি আগের থেকে অন্তত তিনগুণ বেশি মাছ এবার আমাদের উৎপাদন হবে।
একই এলাকায় গলদা চিংড়ির চাষ করছেন আরেক চাষি মিহির রঞ্জন। তিনি বলেন, ‘ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি ঘের করলে আমাদের খরচ সামান্য বেশি হয়, তবে লাভ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। আমরা ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করে এখন সন্তুষ্ট। তাদের এ সাফল্যে ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষে আরও অনেকেই আগ্রহী হয়ে উঠছেন। মফিজুল ইসলাম বলেন, ‘এ পদ্ধতিতে আমার পাশের গ্রামের অনেকেই চিংড়ি চাষ করে লাভবান হয়ে উঠছে। অথচ এ বছরও পানির অভাবে আমাদের অনেক চিংড়ি মারা গেছে। আমি আগামীতে এ পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করতে চাই।
বটিয়াঘাটা উপজেলার "মালতী মৎস্য খামারের" মালিক পঞ্চানন গাইন তিনি সনাতন পদ্ধতিতে ১০ টি পুকুর খনন করে বাগদা চিংড়ী চাষ করছেন। তিনি বলেন, ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিদেশিরা বসে বসে দেখাশোনা করেন। আমরা কিভাবে পোনা ছাড়ি,কিভাবে পরিচর্যা করি এমনকি কিভাবে মাছ তোলা হয় সব তারা পর্যবেক্ষণ করেন। এছাড়া একই পদ্ধতিতে মুনসুর আলী, কৃপা গাইন ও ব্রজেন গাইন বাগদা চিংড়ী চাষ করে আসছে।
এ পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষকে আরও সম্প্রসারণ করার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। দাকোপের পানখালি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাব্বির আহমেদ বলেন, আমাদের এ ইউনিয়নে একটি স্থানে ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ হচ্ছে। কিন্তু এ ইউনিয়নের অধিকাংশ মানুষ চিংড়ির ওপর নির্ভরশীল। এ পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষকে যদি আরও সম্প্রসারণ করা যায়, তাহলে আমাদের ইউনিয়নের আরও অনেক চাষি উপকৃত হবে।
এ বিষয় সাসটেইনেবল কোস্টাল এন্ড মেরিন ফিসারিজ প্রজেক্ট, মৎস্য অধিদপ্তর, খুলনা বিভাগীয় উপ-প্রকল্প পরিচালক সরোজ কুমার মিস্ত্রী বলেন,দীর্ঘ প্রায় ৭/৮ বছর ধরে প্রযুক্তিটি মাঠ পর্যায়ে গবেষণার মাধ্যমে টেকসই উৎপাদন কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশের নিরাপদ চিংড়ি উৎপাদন বৃদ্ধি, উপকূলীয় কৃষি অর্থনীতির উন্নয়ন এবং এসডিজি অর্জনের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করেছে। আশা করা যায়, এই মডেল সম্প্রসারণের মাধ্যমে চিংড়ি সেক্টরে আবার সুদিন ফিরে আসবে। ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ মৎস্য অধিদপ্তরের একটি সফল কার্যক্রম। এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করার ফলে বিভিন্ন গ্রামে একটি মডেল সৃষ্টি হয়েছে। আমরা এ মডেলটি বিভিন্ন উপজেলায় সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহন করেছি। এই পদ্ধতি দেখে আশে পাশের প্রায় ৭/৮ শ চাষি অনুসরণ করছে। এছাড়া উপজেলার প্রায় ৬০০ জন নারী চিংড়ি চাষিকে এই পদ্ধতির প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ৫ লক্ষাধিক মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড চিংড়ি সেক্টরের সাথে জড়িত রয়েছে। মৎস্য অধিদপ্তর এটিকে মডেল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং চিংড়ি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রযুক্তিটি দেশের প্রতিটি উপজেলায় ছড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশনা প্রদান করছে। এছাড়া জেলা প্রশাসনের সহায়তায় ৯টি উপজেলায় মডেলটি সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহন করা হয়েছে। ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে আগামীতে এই প্রকল্পের পরিধি আরো সম্প্রসারণ করা হবে।
সার্বিক বিষয় খুলনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা জয়দেব পাল বলেন,আমাদের অনেক কিছু সীমাবদ্ধতা আছে,তার মধ্যেও আমরা এই চাষকে এগিয়ে নিচ্ছি। যেসব জায়গায় এ পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ হচ্ছে সেসব স্থানে ৩ গুণেরও বেশি চিংড়ি উৎপাদন হবে বলে আশা করছি। আগামীতে এই পদ্ধতি আরও বাড়ানোর লক্ষ আছে আমাদের। চলতি বছর সারাদেশে সনাতন ও উন্নত পদ্ধতি মিলে দুই লাখ ৬৩ হাজার ২৫ হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ করা হচ্ছে,যেখান থেকে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ ৯৫ হাজার মেট্রিক টন। যেখানে দেশে চিংড়ি উৎপাদন হয়েছিল ১ লাখ ৩৭ হাজার ২১ মেট্রিক টন।