শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:৩১ পূর্বাহ্ন
মোঃ ইমানুর রহমান,জেলা প্রতিনিধি, খুলনা, খুলনার তেরখাদা উপজেলার আলোচিত ডাবল মার্ডারে ইউপি চেয়ারম্যান এসএম দ্বীন ইসলামসহ ১৭ আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত । একই সাথে তাদের প্রত্যেককে ৫ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছর বিনাশ্রম কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। রায় ঘোষণার সময় আসামিরা আদালতে উপস্থিত ছিল।
এ মামলার অপর দুই আসামির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ কোন অভিযোগ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় তাদের খালাস দিয়েছেন আদালত।
খুলনা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোঃ নজরুল ইসলাম হাওলাদার এ রায় ঘোষণা করেন।
সাজাপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- তেরোখাদা ছাগলাদাহ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এস এম দ্বীন ইসলাম(৫৪), মোঃ আব্দুর রহমান(৫৫), জমির শেখ(২৫), শেখ সাইফুল ইসলাম (৩৫), খালিদ শেখ (৩২), এস্কেন্দার শেখ (৪২), জসিম শেখ(৩৫), হোসেন শেখ (৩০), জিয়ারুল শেখ (২৬), বাহারুল শেখ (২৪), আব্বাস শেখ(২৪), অহিদুল গাজী (৩৪), খাইরুল শেখ (৩৫), কেরামত মল্লিক (৩৫), মাহবুর শেখ (৪৯), বাবু শেখ (৩৫) ও নুর ইসলাম শেখ (৩৭)।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোঃ আহাদুুজ্জামান বলেন, এ রায়ে রাষ্ট্রপক্ষ খুশি। তবে তিনি মনে করেছিলেন আদালত আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা দিবেন। কিন্তু বিচারক যেটি ভাল মনে করেছেন সেটি করেছেন। এ রায়ের বিরুেদ্ধে তারা উচ্চ আদালতে যাবেন। সেখানে তারা ন্যায় বিচার পাবেন বলে তিনি মনে করেন।
নিহত পিরু শেখের স্ত্রী মাহফুজা বেগম এ রায়ে খুশি নন। এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন। তিনি হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ সাজা দাবি করেন। তিনি বলেন, ওইদিন রাতে আমার স্বামী ও সন্তান বাঁচার জন্য আসামিদের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে আকুতি জানিয়েছিল। কিন্তু ওই সময়ে তাদের মন গলেনি। তিনি হত্যাকারীদের ফাঁসি চান।
এর আগে দুপুর সাড়ে ১১ টায় প্রিজন ভ্যানে করে কারাগার থেকে আদালতে আনা হয়। মামলার রায় শোনার জন্য তেরখাদা ছাগলাদাহ ববিুনিয়ন থেকে কয়েক হাজার মানুষ আদালত চত্বরে ভিড় করেন। আদালতের নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। তাদের সামলাতে পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়।
আদালত সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ৬ আগস্ট রাতে তেরখাদা উপজেলার পহরডাঙ্গা গ্রামের পিরু শেখ ও তার পরিবার রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। রাত ২ টার দিকে দুর্বৃত্তরা দেশীয় অস্ত্রে নিয়ে সিদ কেটে ভিকটিমের ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের ঘরের দরজা বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেয় তারা।
এ সময় উপস্থিত আসামির মধ্যে আব্দুর রহমান হুকুম দিয়ে বলে পিরুকে কুপিয়ে শেষ করে দে। ওর জন্য আমি চাকরী হারিয়েছি। এ কথা বলার সাথে সাথে আসামি সাইফুল হাতে থাকা চাপাতি দিয়ে পিরুর মাথায় কোপ দেয়। কোপে ভিকটিমের মাথার হাড় কেটে ঘিলু বের হয়ে যায়। পরে অন্যান্য আসামিরা পিরুকে এলোপাথাড়ীভাবে কোপাতে থাকে। ভিকটিম ও তার স্ত্রী চিৎকার করতে থাকলে পাশের ঘর থেকে ছেলে নাইম বাবাকে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসলে তাকে টেনে হেচড়ে আসামিরা উঠানে নিয়ে যায়।
আসামি খালিদ শেখ ফলাযুক্ত ফুলকুচি দিয়ে নাইমকে হত্যার উদ্দেশ্যে মাথায় কোপ দেয়। এ সময় ওই অস্ত্র ভিকটিমের ছেলের বুকে বিদ্ধ হয়। যন্ত্রনায় চিৎকার করতে থাকলে আসামি হাবিবুর ও জিয়ারুল চাপাতি দিয়ে নাইমের কেনুই ও ঘাড়ে এলোপাথাড়ি কোপাতে থাকে। ঘটনাস্থলে নাইমের মৃত্যু হয়। আসামিরা চলে যাওয়ার পর পিরু শেখকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়া হয়। পরবর্তীতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পিরু মারা যায়। এ ব্যাপরে নিহত পিরুর স্ত্রী ঘটনা দু’দিন পর বাদী হয়ে তেরখাদা থানায় স্বামী ও সন্তান হত্যার অভিযোগে ১৭ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা আরও ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জেলা গোয়েন্দা শাখার এস আই মুক্ত রায় চৌধুরী ২০২০ সালের ২৯ জানুয়ারি ৩ নং ছাগলাদাহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানসহ ১৯ জনকে আসামি করে আদালাতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
হত্যার কারণ হিসেবে তদন্ত কর্মকর্তা তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, পূর্ব শত্রুতা ও স্থানীয় বিরোধকে কেন্দ্র তেরখাদা ৩ নং ছাগলাদাহ ইউনিয় পরিষদের চেয়ারম্যানের প্ররোচনায় ২০১৬ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সকাল ৮ টায় ভিকটিম পিরু ও তার পক্ষের লোকজনের সাথে আসামি আব্দুর রহমান, খালিদ শেখ ও সাইফুল শেখদের পক্ষের মধ্যে মারপিটের ঘটনা ঘটে। এ সময ঘরবাড়ি ভাংচুরেরও ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় খালিদ ও সাইফুলের পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়। ওই ঘটনায় পিরু শেখের ভাই তাজ শেখ বাদী হয়ে আব্দুর রহমানসহ এজাহার নামীয় অন্যান্যদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। এ ঘটনায় আব্দুর রহমানের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে আবুল হোসেন বাদী হয়ে পিরু, তাজ শেখ ও নাইমের নাম উল্লেখসহ ৩২ জনের নামে মামলা করে। ঘটনার পর থেকে খালিদ, সাইফুল ও তাদের অনেকেই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। ভিকটিম পিরু শেখের ভাইয়ের দায়ের করা মামলায় এজাহার নামীয় আসামি আব্দুর রহমান শিক্ষকতা পেশা থেকে দীর্ঘদিন সাময়িক বরখাস্ত অবস্থায় থাকে। তাছাড়া ভিকটিম পিরু শেখ চেয়ারম্যান দ্বীন ইসলামের অনুসারী থাকলেও ওই ঘটনার পর থেকে দ্বীন ইসলামের বিরোধী পক্ষ ছাগলাদাহ ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন ও তার অনুসারী কাজী তরিকুল ইসলাম তরু ও মঞ্জুর শেখের পক্ষে অবস্থান নেয়। সে কারণে চেয়ারম্যান দ্বীন ইসলাম ক্ষিপ্ত হয়ে আসামি সাইফুল, খালিদ, ও আব্দুর রহমানদের পূর্ব শত্রু পিরু শেখকে হত্যার উদ্দেশ্যে আসামিদের সাথে যোগাযোগ করে। গোপন বৈঠকের মাধ্যমে ৩ লাখ টাকার বিনিময়ে পিরু ও তার ছেলে নাইম শেখকে হত্যা করে।